বড়দিন বা ক্রিসমাস
- এডিট ডেস্ক
- Dec 25, 2019
- 5 min read
Updated: Jun 4, 2023
বড়দিন বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর নবী হযরত ঈসা (আ.) / যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়।

ডেভিড (দাউদ নবী) যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , সেটাই ছিল ইসরায়েলীদের জন্য সত্যিকার অর্থে প্রথম স্বাধীন রাজ্য (Kingdom of Judah)। ডেভিডের পরে তার পু্ত্র সলোমন (সুলাইমান নবী) এই রাজ্যের রাজা হন এবং তারি আমলে এই রাজ্য শৌর্য্য বীর্য অর্থ সম্পদ ও আয়তনে প্রভূত বিস্তার লাভ করে। তবে সলোমনের মৃত্যুর পরে রাজ্যটি অন্তর্দ্বন্দ্ব বিভেদ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে খৃঃপূঃ -৫৮৬ সালে ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার রাজ্যটি দখল করেন এবং হাজার হাজার ইসরায়েলীকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে ব্যাবিলনে নিয়ে যান।
সেই তখন থেকে , ১৯৪৮ সালে বর্তমানের প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইস্রাইল প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত , সুদীর্ঘ ২৫০০ বছর ইসরায়েলী ও অন্যান্য ইহুদীরা , অইহুদী (‘gentiles’) কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছিল এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়ে তারা অব্যাহতভাবে স্বপ্ন দেখত নিজেদের মধ্য থেকে এক পরিত্রাতার (savior), যে কিনা তাদেরকে বিদেশি শাসন থেকে তাদের আবাসভূমিকে মুক্ত করে তাদের সকল গোত্রকে একত্রে বসবাসের সুযোগ করে দেবে। তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এই পরিত্রাতা 'মেসিয়াহ' “Messiah” , যিনি কিনা ডেভিডের বংশধর কেউ হবেন। +২৮/+৩০ সালের দিকে ডেভিডের বংশদ্ভূত এক লোক , যার নাম ছিল যীশু (Jesus يسوع), তার মা , খালা মরিয়ম , ৪ ভাই ও কিছু অনুসারীকে নিয়ে প্যালেস্টাইনে আসেন এবং দাবী করেন যে, তিনিই মেসিয়াহ এবং তিনি এসেছেন রোমান শাসন থেকে প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করে শুধুমাত্র ইসরায়েলী ও ইহুদীদের জন্য স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ডেভিডের সময়কার পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে। যীশু প্যালেস্টাইনকে বেছে নিয়েছিলেন , কারন সেই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা থেকে সর্বাধিক ইসরায়েলী ইহুদীর বাস ছিল এই প্যালেস্টাইনে। প্যালেস্টাইনে আসার পর থেকেই , তিনি শহরে শহরে যেয়ে অত্যাচারী রোমান শাসন থেকে তাদের মুক্ত স্বাধীন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে তার সাথে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাতে লাগলেন। অনেক গরিব সাধারন মানুষ উন্নত জীবণের আকাংখায় তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সাথে যোগ দিল। তবে সচরাচর যা ঘটে থাকে , ইহুদী মোল্লা (Pharisees, Jewish priests of non-Israeli lineage) ও এলিট শ্রেণী তার বিরোধীতা করল। কারন রোমাণ সম্রাজ্যে তারা ছিল সুযোগ ও সুবিধা প্রাপ্ত গোষ্ঠী। এদেরি চক্রান্তে যীশু যে রাতে রোমাণ গভর্ণর হেরডকে হত্যার পরিকল্পনা করেন , সেই রাতে গ্রেফতার হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে বিচারে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ও ক্রুশবিদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলা হয়।
যীশু নামের অখ্যাত অপরিচিত লোকটি ও তার রোমাণ শাসন মুক্ত করে ইহুদীদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ব্যার্থ প্রচেষ্টা , একটি ক্ষুদ্র ঘটনা হিসাবে ইতিহাসের গহ্বরে হয়তো বা হারিয়েই যেত , যদি না তার ৪ ভাই ও কিছু অতি অনুগত অনুসারী গোপনে স্বাধীন ইসরায়েলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে মানুষের মাঝে প্রচারের মাধ্যমে জীইয়ে না রাখত। রোমাণ গভর্নর হেরড তার সকল শাসন ক্ষমতা যীশুর অনুসারীদের দমনে ব্যাবহার করেন ও তাদের ধরে ধরে জেলে পোরেন বা হত্যা করেন। অনেক বছর পরে 'সল' নামে রোমাণ বংশদ্ভূত এক ইহুদী মোল্লা যীশুর অনুসারীদের দমন , অত্যাচার ও নিধনে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি যীশুর অনুসারীদের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং শত শত অনুসারীকে হত্যা করেন। তার এই প্রচেষ্টা সত্বেও যীশুর অনুসারীদের সংখ্যা কমার বদলে বাড়তেই লাগল। রোমাণ ম্যান্ডেট নিয়ে যীশু অনুসারীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে দামেস্ক যান 'সল'। সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় ইহুদী ধর্ম যাজক আনানিয়াসের। আনানিয়াসের বুদ্ধি ও পরামর্শে যীশু অনুসারীদের নির্মূল করার রণকৌশলে আমূল পরিবর্তন আনেন সল। শক্তি প্রয়োগ , হত্যা , জেল জুলুমের পরিবর্তে ভিন্ন পন্থায় ভিতর থেকে যীশু প্রবর্তিত স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনার পরিবর্তন করে তাদের আন্দোলনকে দমানোর উদ্যোগ নেন। তার নুতন কৌশলের অংশ হিসাবে , তিনি যীশুর অনুসারীদের মধ্যে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচার শুরু করেন যে , যীশু কখনোই ইহুদীদের মুক্ত করে স্বাধীন ইসরায়েলী রাষ্ট্র করার জন্য আসেন নি , বরং সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে মুক্ত করার জন্য এই ধরাধামে আগমন করেছিলেন এবং সকল মানুষের পাপমোচনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। এ পৃথিবীতে নয় , বরং তার রাজত্ব হবে মৃত্যু পরবর্তি জমানায়। বছরের পর বছর যীশুর অনুসারীরা সলের এই ভ্রান্ত প্রচারনা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোন চেষ্টায় কাজে আসেনি , কারন সল এই সময় 'পল' নাম ধারন করেন ও তার সমর্থনে ছিল রোমাণ রাজশক্তি। ফলে পলের অনুসারীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং যীশুর ভাই ও অনুসারীরা স্বাধীনতা কামী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে দেশ ও সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে খৃষ্টান ধর্মের উৎপত্তিই হয়েছিল স্বাধীনতাকামী ইহুদীদের ইসরায়েলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও আন্দোলনকে বান্চাল করার মানসে পল ও আনানিয়াসের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এই নুতন ধর্ম ও হয়তো হারিয়েই যেত , যদি না রোমাণ প্যাগান রাজা কনস্টান্টিন ৪০০ বছর পরে একে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারী ধর্ম হিসাবে ঘোষণা দিতেন। ফলে খৃষ্টান ধর্ম নব জীবণ লাভ করে এবং এর অনুসারীর সংখ্যা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে বাড়তে বর্তমান অবস্থায় পৌচেছে। প্যাগান কনস্টান্টিনের রাজত্বকালেই নিসেন কাউন্সিলে খৃষ্টান ধর্মের মূল মতবাদগুলো গৃহীত হয় এবং রাজা কনস্টান্টিনকে খুশি করার জন্য প্যাগানদের কিছু রীতি নীতি খৃষ্টান ধর্মে অনুপ্রবেশ করানো হয়। যেমন - রোববারে প্রার্থনা (প্যাগানদের রবি বা সূর্য দেবতার সম্মানে), খৃষ্টমাস , সান্টাক্লজ , ইস্টার ইত্যাদি। পক্ষান্তরে বর্তমানের মুসলমান নামধারীরা বিশ্বাস করেন যে -
১) আদি খৃষ্টান ধর্ম আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী মরিয়ম পুত্র ইসা কর্তৃক প্রচলিত ধর্ম যা পরবর্তিতে বিকৃত হয়েছে। ২) খৃষ্টানদের আদি ধর্ম গ্রন্থ ইন্জিল , যা পরবর্তিতে একাধিক ধর্মযাজক কর্তৃক বিকৃত হয়ে বর্তমানের নিউটেস্টামেন্টে পরিণত হয়েছে। ৩) যীশুই (يسوع) ইসা (عيسى) এবং নামের উচ্চারনের এই ভিন্নতার কারন হলো ইসা কে হিব্রুতে যীশু বলা হয়। খৃষ্টান ও মুসলমানরা যে সকল বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেন -
১) যীশু/ইসার জন্ম কুমারী মাতার গর্ভে। ২) তিনি জীবিত অবস্থায় স্বর্গারোহন করেছেন , এখনো জীবিত আছেন এবং ভবিষ্যতে কোন এক সময় পুনর্বার এই ধরাধামে আসবেন আল্লাহর/গডের শাসন প্রতিষ্ঠায় , যদিও কোরানে বলা আছে তিনি আর সকল নবী রসূলের মতোই মৃত্যু বরণ করেছেন। আসলেই যীশু ও কোরানে বর্ণীত মরিয়মপুত্র ইসা কি একি ব্যাক্তি , নাকি ভিন্ন দুই জন ব্যাক্তি , যাদের জন্মস্থান ও বিচরন কাল ভিন্ন ছিল? পরবর্তি পর্বগুলোতে কোরান নিউটেস্টামেন্ট ও ইতিহাস থেকে এর উত্তর খোজার চেষ্টা করব। আল-কুরানের আলোকে খৃষ্টান ধর্মের উৎপত্তি ও এর বিবর্তন এবং সেইসাথে কোরান ও নিউ টেস্টামেন্টের তুলনা নিয়ে সাম্প্রতিক পঠিত একট সুন্দর লেখা সকলের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই এই পোস্ট। কোরানের মরিয়ম পুত্র ইসা ও নিউ টেস্টামেন্টের যীশু কি একি ব্যাক্তি? এর উত্তর খুজতে গেলে খৃষ্টান ও মুসলমান দাবীদার উভয় গোষ্ঠীর রোশানলে পড়া বিচিত্র নয়। কারন উভয়েই যীশু/ইসাকে নিয়ে বিভ্রান্ত। পবিত্র কোরানের সূরা মারইয়ামে হজরত ঈসার (আ.) জন্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়াও পবিত্র কোরানের ১৫টি সূরার ৯৮ জায়গায় হজরত ঈসার (আ.) জীবনের নানা দিক ও বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইহুদিরা হজরত ঈসাকে (আ.) নবী বলে স্বীকার করে না। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা তাকে আল্লাহর পুত্র জ্ঞান করে থাকে। আর মুসলমানরা তাকে একজন সম্মানিত নবী ও রাসূল বলেই মানে। ইহুদিরা হজরত ঈসাকে (আ.) হত্যা করার দাবি করে থাকে। আর খ্রিস্টানরা মনে করেন ঈসা (আ.) তার ওপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খ্রিস্টানের পাপের বোঝা কাঁধে নিজে নিয়ে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ এ উভয় দাবিই মিথ্যা। এ প্রসঙ্গে কোরানে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এ বিষয়ে তাদের কোনোই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি।’ সূরা আন নিসা: ১৫৭
ইসলাম ধর্মে হজরত ঈসার (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে স্বীকার করা হয় না। বলা হয়, ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য যখন বাহক তাকে নিতে ঘরে প্রবেশ করে তখন আল্লাহতায়ালা তাকে আসমানে তুলে নেন এবং বাহকের চেহারাকে হজরত ঈসার (আ.) চেহারার অনুরূপ করে দেন। ফলে ঈসা (আ.) মনে করে ওই বাহককে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। বস্তুত ঈসা (আ.) বর্তমানে আসমানে অবস্থান করছেন। কিয়ামতের পূর্বে দাজ্জালের আবির্ভাবের পর ঈসা (আ.) শেষনবী হজরত মুহম্মদের (সা.) একজন অনুসারী হিসেবে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। এরপর সমস্ত পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। সবশেষে তিনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন এবং হজরত মুহম্মদের (সা.) কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে, যে কারণে মদিনায় নবী করিমের (সা.) কবরের পাশে তার কবর দেয়ার জায়গা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
শব্দঃ ১২১০
তথ্যঃনেট
Comentarios